You can access the distribution details by navigating to My pre-printed books > Distribution
বঙ্গ, বাঙ্গাল ইত্যাদি শব্দের যুক্তিনির্ভরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যার খোঁজে নারু যে যুক্তিনির্ভর যাত্রা শুরু করেছিল, সেই পথচলায় সে উপনীত হয়েছিল বঙ্গ নামের অস্তিত্বে আসা নিয়ে একটি অশ্রুতপূর্ব ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যায়। সেই ব্যাখ্যা, সেই অববাহিকার ভূতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক বিবর্তনের যে সময়সারণি সেই সব অধ্যয়ন ক্ষেত্রের প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞগণ প্রদান করে থাকেন, তার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হয়েছিল।
উদ্যোগের পরিসমাপ্তির মুখে এসে আহৃত তথ্যভান্ডার, যুক্তিশৃঙ্খলার সাথে মিশে, নারুর মনকে দাঁড় করিয়েছিলো এক নতুন দিগন্তের সামনে। সেই পটভূমিতে, অল্প কিছু সময় পরেই নারু উপলব্ধি করেছিল যে সে যাত্রার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে তাকেও সেই পথটি গ্রহণ করতে হবে যে পথটি গ্রহণ করার কথা অধ্যাপক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ভেবেছিলেন। নারুর মনে প্রত্যয়ের উদ্রেক হয়েছিল যে বাংলার ও স্বভাবতই বাঙ্গালীর সংস্কৃতিই সম্ভবত একমাত্র পথ যার মাধ্যমে বাংলা অববাহিকা অঞ্চলের ইতিহাসের ধূসর অতীত পর্যায়ে উঁকি দেওয়া সম্ভব। অপর যে কোনো পন্থা অবলম্বনে ইতিহাসের সেই পর্যায় অধরাই থেকে যায়।
ভারতীয় ইতিহাসকার এবং সেই সূত্রে বাংলার ইতিহাসকারদেরও প্রাচীন ভারতের পটকথায় একটি এমন মানব গোষ্ঠীর অবতারণা করতে হয়, যাঁরা ভারতের ইতিহাসের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে সেই ভূমে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং যাঁদের অতি উচ্চ স্তরের মেধা ও আত্মোপলব্ধি ছিল; সেকথা ধরে নেওয়া জরুরী হয়ে পরে। প্রাগৈতিহাসিক তথা প্রাচীন ভারত সম্পর্কিত যে সমস্ত ধারণা বর্তমান মানুষের হাতে এসে পৌঁছেছে সেগুলিকে যুক্তিসম্মত ভাবে আত্মস্থ করতে হলে সেই ঘটনার অবতারণা অবশ্য প্রয়োজন হয়ে পরে। সেই কল্পিত উন্নত মানব সমাজের অস্তিত্বের কেবল আভাসমাত্রই পাওয়া যায়, তার অস্তিত্বের স্বপক্ষে কোনো বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক জগতের কল্পনাতীত উচ্চতা সেই প্রকার এক সমাজের অস্তিত্বের প্রতি নির্দেশ করে। অতএব ইতিহাসের প্রত্যেক যাত্রীকেই ভারতের ও বাংলার ইতিহাসের প্রাচীন পর্যায়ে সেই প্রকার একটি অধ্যায়ের অবতারণা করতেই হয়।
ইতিহাসের সেই পর্যায়ে এসে, অর্থাৎ অতীতের যে পর্বে ভারতভূমে একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল জনগোষ্ঠীর উপস্থাপনা করতে হয়, সেখানে পৌঁছে ভারতবর্ষের সুদূর অতীত অভিমুখে যে কোনো যুক্তিনির্ভর যাত্রার আকস্মিক অন্ত ঘটে। আজ অবধি এমন কোনও প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা যায়নি যা অস্পষ্ট ভাবে হলেও সেই ভূমির রহস্যময় অতীতকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করতে পারে। কেউই সেই রাস্তায় হাঁটার সাহস প্রদর্শন করেননি। সেই প্রকার কোনো প্রস্তাবনাকে যুক্তিনির্ভর ভাবে প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব।
রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের বোধগম্য গতিধারার সাথে যুক্তিনির্ভর সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য সেই প্রস্তাবিত, অতি উন্নত গোষ্ঠীর ‘আত্মঘাতী পতন’ কে দায়ী করেছেন। এই জাতীয় একটি সভ্যতার অস্তিত্বের উপস্থাপনা এবং সেই সভ্যতার পরবর্তী পতন বা অবনমন হল এমন একটি প্রস্তাব, যা ভারতের অতীতের ইঙ্গিতসমূহকে বোঝার যুক্তিনির্ভর প্রবাহকে অক্ষুণ্ন রাখতে অনিবার্য হয়ে পড়ে।
জ্ঞাত ও প্রমাণিত ইতিহাসে, মানবজাতি রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে একটি সভ্যতার অবনমনের সাক্ষ্মী থেকেছে। মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার প্রাচীন ইতিহাসে যখনই কোনো ব্যাখ্যাতীত যতি দেখা যায়, তখনই সেই ধূসর অধ্যায়টিকে সংশ্লিষ্ট সমাজের স্বতঃপ্রণোদিত পতনের জন্য দায়ী করা সহজ হয়ে যায়, কারণ একই ধরনের উদাহরণ প্রমাণিত ইতিহাসে বর্তমান।
ভারতের ক্ষেত্রে অসাধারণ মাত্রার কিছু ঘটেছিল। একটি সম্পূর্ণ কল্পিত সভ্যতা তার চিহ্নের কোনো অস্তিত্ব ব্যতিরেকেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই অনুমানিত সভ্যতার সাথে সম্পর্কিত কোন পুরাতাত্ত্বিক অথবা অন্য কোন প্রকার বাস্তব প্রমাণ বর্তমান মানুষের হাতে এসে পৌঁছায়নি। নথিভুক্ত ইতিহাস যতদূর প্রকাশ করে, তা থেকে দেখা যায় যে পৃথিবীর অন্যান্য অনুরূপ ক্ষেত্রে অর্থাৎ যেখানে চূড়ান্ত মাত্রার সভ্যতাগত বা সামাজিক পতন ঘটেছিল, সেখানে কিছু বাস্তব অবশেষ, অর্থাৎ সেই ধরনের মানুষের অস্তিত্বের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন : “রাজকৃষ্ণবাবু মনে করিলে বাংলার সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখিতে পারিতেন : তাহা না লিখিয়া তিনি বালকশিক্ষার্থ একখানি পুস্তক লিখিয়াছেন। যে দাতা মনে করিলে অর্দ্ধেক রাজ্য এক রাজকন্যা দান করিতে পারে, সে মুষ্টিভিক্ষা দিয়া ভিক্ষুককে বিদায় করিয়াছে”।
বাঙ্গালী সমাজের উদ্ভব সংক্রান্ত একটি রচনায় তিনি লিখেছিলেন যে "কেবল ব্রাহ্মণ কায়স্থে বাঙ্গালা পরিপূর্ণ নহে, ব্রাহ্মণ কায়স্থ বাঙ্গালীর অতি অল্পভাগ। বাঙ্গালীর মধ্যে যাহারা সংখ্যায় প্রবল, তাহাদিগেরই উৎপত্তিতত্ত্ব অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন"।
নারুর মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছিল যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন পরম বস্তুবাদী ব্যক্তি, যিনি পাশ্চাত্য চিন্তাধারার প্রভাব সম্পূর্ণরূপে প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সেই সময় পর্যন্ত জনসমক্ষে প্রকাশিত সমস্ত পণ্ডিতদের লেখা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন, তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে “বাঙ্গালার ইতিহাস নাই”।
রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন “ভূ-বিদ্যাবিশারদের নিকটে বাঙ্গালাদেশের শৈশব এখনও অতিক্রান্ত হয় নাই। এই নূতন দেশে বহু প্রাচীন আদিম মানবের অস্তিত্বের নিদর্শন আবিষ্কৃত হইবে, ইহা বোধ হয় কাহারও ধারণা ছিল না”।
বিশেষজ্ঞদের লেখা থেকে অনুভব করা যায়, বাংলা অববাহিকার ভূগোল ও ইতিহাসের অতীত অধ্যায়ের সাথে একটি ‘অস্পষ্টতা’ জড়িত। এবং, বাঙালী সমাজের বিবর্তনের ক্ষেত্রেও একটি ‘অব্যাখ্যাত অস্তিত্ব’-র অনস্বীকার্য উপস্থিতি রয়েছে। যেন এক অতি প্রভাবশালী অশরীরী অবিরত তাঁর অনস্বীকার্য অস্তিত্বের নির্ঘোষ করে চলেছে।
নারু দেখতে চেয়েছিল যে সে বাংলা অববাহিকার সাথে সম্পৃক্ত সেই ‘অব্যাখ্যাত অস্তিত্ব’ যা সর্বদাই উপস্থিত ছিল ও সেই সময়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা যাত্রিকদের চিন্তায় ধরা পড়েছিল এবং ঐতিহাসিক সময়কালের সেই পর্যায়ের, যে পর্যায়ের স্বপক্ষে কোনও বাস্তব প্রমাণ উপস্থিত নেই, সে তার প্রকৃত স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম করার দিশায় চিন্তার একটি পথ খুঁজে বার করতে পারে কিনা। অতীতের সেই ধূসর পর্যায়কে ‘ইতিহাস’ বলা যেতে পারে। প্রাচীন ভারতীয় রচনাবলীতেও এই শব্দটি একই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। নারু একটি নতুন প্রকারের যাত্রার উদ্দেশ্যে তার মননের ভেলা ভাসাতে মনস্থ করেছিল, যেখানে বাংলার প্রাচীন অধিবাসীদের জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিকের ধারণা সংগ্রহ করা, সেই অববাহিকাটির ইতিহাসের সাথে জড়িত ‘অব্যাখ্যাত অস্তিত্ব’–র অবগুন্ঠন উন্মোচন করার নিমিত্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।
শেষ পর্যন্ত, নারু এমন একটি সূত্র খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছিল, যার মাধ্যমে সে বঙ্গীয় অববাহিকার অতীতের গভীরতায় তার যাত্রা চালিয়ে যেতে সক্ষম হতে পারে। বর্তমান বইটি সেই অতি-গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের ও সেই সূত্র খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়ার বিবরণ প্রদান করে।
Currently there are no reviews available for this book.
Be the first one to write a review for the book বাংলার উৎপত্তি নবম পর্ব বাংলা , বাঙালী , সংস্কৃতি , ও অশরীরীর প্রচ্ছায়া.